রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মাত্র দুদিন আগে একজন বন্ধু তার সাথে দেখা করতে এসেছিল। বন্ধুটি রবীন্দ্রনাথকে বলল, “তুমি অত্যন্ত সফল একটি জীবন কাটিয়েছো। এই মুহূর্তে তোমার আর আক্ষেপ করার কিছুই নেই।” তারা উভয়ই সেই ছোটবেলাকার বন্ধু ছিল এবং তারা এখন দুজনেই তাদের বার্ধক্যে পৌঁছে গেছে। বন্ধুটি বলতে লাগল, “তুমি এখন শান্তিতে মৃত্যুবরণ করতে পারো। আমি এই জীবনে কোনকিছুই অর্জন করতে পারিনি, আমি এ জীবনটাকে এতটাই অপচয় করেছি যে আমি শান্তিতে মরতেও পারবো না। আর এদিকে তুমি অজস্র গান রচনা করে ফেললে!”
রবীন্দ্রনাথ ছয় হাজার গান রচনা করেছে। এই পৃথিবীর অন্যকোন কবি এতসংখ্যক গান রচনা করতে পারেনি। শেলী পাশ্চাত্যের একজন বিখ্যাত কবি। কিন্তু তার গান রচনার সংখ্যা প্রায় তিন হাজারের মত; যেখানে রবীন্দ্রনাথের গান রচনার সংখ্যা ছয় হাজার এবং এগুলোর প্রত্যেকটি দিয়েই সঙ্গীত রচনা করা সম্ভব।
সেই বৃদ্ধ বন্ধুটি বলল, “তোমাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে; তোমার ওপর সম্মান ও শ্রদ্ধার অবারিত বারি বর্ষিত হয়েছে, তুমি শান্তিপূর্ণভাবে মরতে পারো। আর অবশ্যই আমি কোনপ্রকার শান্তি ছাড়াই মারা যাবো। অন্যদিকে তুমি স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাতে পারবে যখন তুমি এ পৃথিবীকে বিদায় জানাবে।
রবীন্দ্রনাথ এতক্ষণ তার বন্ধু যা বলছিলো তার সবই শুনল। এরপর সে বলতে লাগল, “বেশ ভালো, তবে আমি যে গানটি গাইতে চেয়েছিলাম তা এখনও আমি গাইতে পারিনি, এটা এখনও আমার অন্তরে বীজের মত সুপ্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। এই ছয় হাজার গান হলো সেই একটি গান গাইবার সকল ব্যর্থ প্রচেষ্টা। আমি চেষ্টা করেছিলাম সেই একটি গান গাইবার জন্য যা আমার হৃদয়ে সুপ্তবীজ আকারে গ্রথিত হয়ে ছিলো কিন্তু প্রতিবারই আমি ব্যর্থ হয়েছি। তুমি হয়তো সেই গানগুলোকে পছন্দ করে থাকতে পারো কিন্তু সেগুলো হল আমার ব্যর্থতার গল্প। আমার গান এখনও গাওয়া হয়নি। আমি এখনও পর্যন্ত গানটি গাইতে পারিনি। আর দেখো স্রষ্টা আমাকে নিয়ে যাবার জন্য এসে গেছে। এইমাত্রই আমি আমার যন্ত্রের সুর ঠিক করছিলাম; অনেক কষ্ট করে আমি আমার সেতারের সুর ঠিক করতে সমর্থ হলাম। এখন আমি পরিপক্ক হয়েছি, আমার বাদ্যযন্ত্রও প্রস্তুত, আমার আত্মাও তৈরী, এই কেবলমাত্র গানটি গাইবার মুহূর্ত এলো, আর এখনই কীনা আমি চলে যাবো।
হে স্রষ্টা আমি তোমার কাছে নালিশ জানাচ্ছি।”