একজন বেলাবোস ও কিছু অনুভূতি
১১০০ টাকা মাইনের চাকরী পেয়ে মিনিট পাঁচেক আবেগী আলাপ আর বিনিময়ে কিছু ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ – অঞ্জন দত্ত একটা আলোড়ন তৈরি করেছিলেন এই বেলাবোসকে সামনে এনে । গানটা বের হওয়ার পর অঞ্জন দত্তের নামে মামলা করেছিলেন “২৪৪১১৩৯” নম্বরের মালিক । পরবর্তীতে তাকে বাধ্য হয়ে ফোন নাম্বারটি বন্ধ করে দিতে হয়েছিল । আমরা খুব কম মানুষই হয়ত এমন সিচুয়েশনে পড়েছি তবুও “বেলাবোস” কিংবা “২৪৪১১৩৯” আমাদের মনে গভীর আঁচড় আঁকতে সক্ষম । সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবীতে আজ অনেক পরিবর্তন এসেছে । বদলেছে সময়, বদলেছে পরিস্থিতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, কিন্তু বেলাবোস কিংবা অমন নাম্বারের সংখ্যায় কিন্তু পরিবর্তন আসে নি, বরং বেড়েছে ।
.
আমার ধারণা পরিবর্তনের শুরুটা বুঝতে হলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে । প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, চিনে মাও সে তুং এর কমিউনিজম এর গোড়াপত্তন, এইগুলা কিন্তু স্বল্প বিরতিতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা । এবার বর্তমান পৃথিবীর সাথে তুলনা করা যাক, বর্তমানে যুদ্ধ বিগ্রহ তুলনামূলকভাবে কমে গিয়েছে, হ্যাঁ বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় ঘটনা ঘটছে, কিন্তু গত ১০০ বছরের তুলনায় সেটা খুব ই কম। আমরা এখন শান্তি চাই এবং এই আমূল পরিবর্তনের চাবিকাঠি হল, “ভালবাসা” । আপনি বব ডিলান এর গানগুলোর দিকে লক্ষ করেন, তার গান মানেই ছিল প্রটেস্ট মিউজিক । যেখানে Blowing in the Wind এর মত প্রতিবাদী গানগুলো তৈরি হয়েছে, সেখানে বব ডিলানই Rock n Roll ধরণের গানের দিকে শিফট করলেন । যেখানে অনুভূতি, প্রেম-ভালবাসা ও পাওয়া না পাওয়ার ব্যপারগুলো বেশি প্রাধান্য পাওয়া শুরু করলো । সময়ের সাথে সাথে এই পরিবর্তনগুলো আসছে, এবং ভবিষ্যতেও আসবে বলেই আমার ধারণা । বেলাবোসকে নিয়ে বলতে গিয়ে, যুদ্ধ, গান, বব ডিলানকে টেনে আনার পেছনে কারণ আছে । বর্তমানে যেহেতু যুদ্ধ-বিগ্রহ আগের তুলনায় অনেকটা কমেছে, তাই বর্তমানে আমাদের মধ্যে ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা বেড়ে গিয়েছে আগের তুলনায় এবং এই কারণেই বর্তমানে প্রেম-ভালবাসা সংক্রান্ত সমস্যা গুলো বেড়ে গিয়েছে, ব্রেকআপ-বিচ্ছেদ কিংবা বেলাবোসদের মত সিচুয়েশন এখন বেড়েই চলেছে ।
.
এবার ফিরে আসি উনিশ শতকের শেষের দিকের কোলকাতায়, আমাদের ভাষায় অনেকটা সাদাকালো সময় । যখন প্রেমিক প্রেমিকার সর্বোচ্চ ঘনিষ্ঠ মূহুর্ত ছিল দুজনের হাতের সবচেয়ে ছোট্ট আঙুলে আঙুল গুঁজে দিয়ে ফুটপাত ধরে হাটা, কিংবা কোন এক সস্তা রেস্তরায় পর্দা টেনে দিয়ে দুজন এর কথোপকথন । তখনো তারা হয়ত রুম ডেটিং এর পর্যায়ে পৌঁছে নি । অঞ্জন দত্ত গানটা মূলত এমন একটা সময়কে সাক্ষী রেখে লিখেছিলেন, যখন মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছিল, স্কুল-কলেজের ছেলে মেয়েরা ভয়ে ভয়ে প্রেম করছে, মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত বেকার যুবকের সংসারের হাল ধরার পূর্ব মুহূর্তের কিছু দুশ্চিন্তা ইত্যাদি। প্রেম-ভালবাসা যতটা আবেগ দিয়ে হয়, বাস্তবতা ততটা সেই পথে হাটে না । বাস্তবতা কঠিন পাথরের মত অবিচল । রেস্তরার কেবিনে বসে পর্দা টেনে দিয়ে ওরা ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন দেখতো, এতটাই ছোট যে সেটা গল্প উপন্যাসেই বেশি মানায় । সময়ের সাথে সাথে মেয়েটা বুঝতে পারে অত ছোট্ট স্বপ্ন, অত ছোট্ট সংসারে ওর চলবে না, ছেলেটাও ধীরে ধীরে তার দৌড় কতটুকু বুঝতে পারে । একটা সময় পর ছেলেটা গ্রাজুয়েশন শেষ করে বের হয়, বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছে ভেবে পরিবার থেকে মেয়েটার বিয়ের জন্যে চাপ দেয় । তখনকার সময়ের মেয়েরা বোধহয় আজকালকার মত অত সাহসী ছিল না, বেলাবোস এর মত লক্ষ্মী ছিল। পরিবারের সিদ্ধান্তই মুখ বুজে মেনে নিত । ফলে ফোনের ওপাশ থেকে অঞ্জন দত্তরা ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ছাড়া কিছুই শুনতে পেত না।
.
তাহলে বেলাবোসদের কি হবে? কেন? কি আবার হবে? তারা সংসার করবে । বেলার থেকে বেলার বাবা মা জানেন সংসার করতে কি লাগে। ভালবাসার চাইতেও বেশি দরকার যথেষ্ট আর্থিক সচ্ছলতা। তারা জানেন ১১০০ আর ১১০০০ টাকার মধ্যেকার এই শূন্য এর পার্থক্য কতটুকু । সত্যি বলতে বেলাবোসরা ভালই থাকে, একটা সচ্ছল, সিকিউরড ভবিষ্যৎ যেখানে টানা পোড়ন নেই, হিসেব করে করে খরচা করার চিন্তা নেই, ভবিষ্যতে সন্তানকে একটা ভাল ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর দুশ্চিন্তা নেই । আর ভালবাসা? সে তো সব ছেলেই বাসতে পারে.. হয়ত নতুন এক ধরণের ভালবাসা পাবে বেলা । বিয়ের শুরুতে হয়ত ভালবাসাটা কিংবা ভালবাসার মানুষটা একটু অচেনা থাকবে, সময়ের সাথে সাথে সেই হবে সবচেয়ে আপন এবং প্রিয় মানুষ । তখন ২৪৪১১৩৯ ফোন করে হয়ত আর বেলাবোসদের পাওয়া যাবে না, শ্বশুরবাড়ির নাম্বারটাও হয়ত ছেলেটা খুঁজে বের করতে পারবে না ।
.
তারপর ও কোন এক বৃষ্টির রাতে বেলাবোসেরা নস্টালজিক হয়ে উঠবে । জানালার গ্রিল ধরে বৃষ্টি দেখবে আর মনে পড়বে তার প্রেমিকের কথা, মনে পড়বে কেণো আঙুল ছুঁয়ে ফুটপাত ধরে হাটতে হাটতে স্বপ্ন দেখার সময়গুলো, ঝুম বৃষ্টিতে একসাথে টং এ দাঁড়িয়ে ধোয়া ওঠা চা খাওয়ার সময়গুলো । এই একি বৃষ্টির ছাট বেলাবোস এর স্বামীর মনে এক অন্য চাহিদার জন্ম দিবে । গ্রিল ছেড়ে বিছানায় আসতে বলবে সে বেলাকে । বেলা লক্ষ্মী-বাধ্য মেয়ে, সে তার স্বামীকে বাধা দিবে না, যেমনটা সে বাধা দেয় নি তার বাবা-মার সিদ্ধান্তে । এরপর এক পরিণত আদিম ভালবাসার সাক্ষী হবে বেলা, মূহুর্তেই ভুলে যাবে পুরনো প্রেমিকের সাথে দেখা ছোট্ট ছোট্ট লাল নীল স্বপ্নগুলো । রাতের বৃষ্টির সাথে ধুয়ে যাবে বস্তাপচা পুরনো স্মৃতিগুলো। এরপর নতুন এক সকাল, নতুন সূর্য, কপালে সিঁদুর লাগিয়ে লাল শাড়িতে স্বামীর ঘুম ভাঙানোয় চেস্টারত এক অত্যন্ত বাধ্য বেলাবোস।
লিখেছেনঃ আবির রায়হান